পারিভাষিক শব্দের আলোচনা এবং ব্যখ্যা ও প্রয়োজনীয়তা
পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ
‘ভাষা’ শব্দের পূর্বে ‘পরি’ উপসর্গযোগে ‘পরিভাষা’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। এর আক্ষরিক অর্থ-‘বিশেষ ভাষা’। অর্থাৎ, পারিভাষিক শব্দের অর্থ হল কোনো ভাষার মধ্যে বিশেষ অর্থে ব্যবহারযোগ্য শব্দ।
আরো পড়ুনঃ
বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে।
অন্যভাবে বলা যায়, মূলশব্দের মৌলিক অর্থ ও ভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে এক ভাষার শব্দকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করে যে রূপ দান করা হয় তাকেই ‘পরিভাষা’ বলে। এই বিবেচনায় বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দগুলোকেই পরিভাষা নামে অভিহিত করা যায়। যেমন— Act শব্দের পরিভাষা হলো আইনের ধারা ৷
পারিভাষিক শব্দ (Terminology) বা পরিভাষা কী তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত বাংলা অভিধান ‘চলন্তিকা’র সংকলয়িতা রাজশেখর বসু বলেছেন, “অভিধানে পরিভাষা অর্থ সংক্ষেপার্থ শব্দ। অর্থাৎ যে শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনও বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তা পরিভাষা। যে শব্দের অনেক অর্থ, সে শব্দও যদি প্রসঙ্গ বিশেষে নির্দিষ্ট অর্থে প্রযুক্ত হয় তবে তা পরিভাষা-স্থানীয়। সাধারণত ‘পরিভাষা’ বললে এমন শব্দ বা শব্দাবলি বোঝায় যার অর্থ পণ্ডিতগণের সম্মতিতে স্থিরীকৃত হয়েছে এবং যা দর্শন বিজ্ঞানাদির আলোচনায় প্রয়োগ করলে অর্থবোধে সংশয় ঘটে না।” (বসু : ১৩৪০)
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষা কোনো না কোনোভাবে অন্য ভাষা থেকে উপাদান গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়। এই সংগৃহীত উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল পরিভাষা। বাংলা-ভাষা ব্যবহারকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই তাদের দৈনন্দিন কাজে কম-বেশি পরিভাষা ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, ধর্মতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি শাস্ত্রীয় বিষয়ের শব্দের প্রয়োজন হলে এ ধরনের পরিভাষা কোনো ভাষাতে সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। মাতৃভাষায় গৃহীত এ জাতীয় মূল বিদেশি শব্দ, বিদেশি শব্দের অনুবাদ বা বিদেশি শব্দের কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপই হলো পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ; অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যেসব শব্দ সুনির্দিষ্ট বা বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয় সেগুলোই পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ।
পারিভাষিক শব্দের আলোচনা এবং ব্যখ্যা ও প্রয়োজনীয়তা
সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার ব্যাপক উৎকর্ষ সাধনের ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধারণা, বস্তুসামগ্রী, ঘটনা, কাজ ইত্যাদির জন্ম হচ্ছে যা কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পৃথিবীর সকল ভাষার লোকের মধ্যে তা বিস্তৃত। সাধারণত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যে দেশ যত অগ্রগামী সে দেশের মানুষ তাদের নিত্যনতুন উদ্ভাবিত জিনিসগুলোকে এবং অপরাপর সকল বিষয় মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। ফলে অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর লোকজন সেসব বিষয়ে
ধারণা নেয়ার জন্যে কিংবা জ্ঞানার্জনের জন্যে ওইসব বিষয়ে ব্যবহৃত শব্দসমূহ কখনো নিজের ভাষায় অনুবাদ বা শব্দার্থ করে, কখনো হুবুহু, কখনো-বা পরিভাষার মাধ্যমে অর্থ করে নিজেদের জীবনধারণের অগণিত প্রয়োজনীয় দাবি মেটায়। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ শব্দ এবং পারিভাষিক শব্দের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য টেনে দেয়ার প্রয়োজন থাকলেও ভাষার কোন্ শব্দটি পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং কোন শব্দটি হবে না সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। তাছাড়া সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে ফেলার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে হয় না; কেননা তার ফলে ভাষার ওপর জোর করে নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে ভাষাকে সহজ করার স্থলে জটিল অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।
লক্ষ করলে দেখা যায় যে বঙ্গানুবাদ, শব্দার্থ এবং পরিভাষার ক্ষেত্রে পার্থক্য যৎসামান্যই। আর যেটুকু পার্থক্য তা ধরা পড়ে কোনো শব্দকে পরিভাষা হিসেবে ব্যবহারের সময় অথবা কোনো শব্দের প্রতিশব্দ কিংবা বঙ্গানুবাদ না পাওয়া গেলে। আবার একই শব্দ সাধারণ শব্দভাণ্ডারে যেমন ব্যবহৃত হতে পারে তেমনি বিশেষ পারিভাষিক অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন ‘গুণ’ শব্দটি সাধারণ শব্দভাণ্ডারে নানা অর্থে ব্যবহৃত হলেও গণিতের ক্ষেত্রে ‘গুণ’ একটি পরিভাষা। আবার ‘নিওন’ (গ্যাস) শব্দটি পরিভাষা হলেও বাংলায় আমরা যখন ‘নিওন বাতি’ বলি তখন ‘নিওন’ শব্দটি সাধারণ শব্দের এলাকায় অবলীলায় ঢুকে পড়ে।
ভাষাতাত্ত্বিক আইনার হগেন বলেছেন, ভাষা-সমস্যা হলো ভাসমান বিশাল বরফ-পাহাড়ের মতো, যার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র দৃষ্টিগোচর হয়, বিশালাংশ থাকে নিমজ্জিত। বাংলা ভাষা-সমস্যা সম্পর্কেও কথাটি প্রযোজ্য। বাংলা ভাষা-সমস্যার ক্ষদ্রাংশ বাঙালির চেতনায় বিধৃত হয়েছে, বিশালাংশ আছে জাগ্রত-চেতনার বাইরে। বাংলার বিদ্বৎ-সমাজ পরিভাষাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পরিভাষা সৃষ্টির সমস্যা সম্পর্কে অর্থাৎ নতুন শব্দ সৃষ্টির সঙ্কট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— “বাংলা ভাষায় গদ্য লিখতে নতুন শব্দের প্রয়োজন প্রতিদিনই ঘটে। অনেকদিন ধরে অনেকরকম লেখা লিখে এসেছি। সেই উপলক্ষে অনেক শব্দ আমাকে বানাতে হোলো। কিন্তু প্রায়ই মনের ভিতরে খটকা থেকে যায়। সুবিধা এই যে, বারবার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দ বিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে ওঠে, মূলে যেটা অসঙ্গত, অভ্যাসে সেটা সঙ্গতি লাভ করে।” (ঠাকুর : ১৩৩৬)
পারিভাষিক শব্দের আলোচনা এবং ব্যখ্যা ও প্রয়োজনীয়তা
পরিভাষা ও শব্দের পার্থক্য মও পরিভাষার মধ্যে সঙ্গ: পার্থক্য বিদ্যমান।
শব্দ ও পরিভাষার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। পরিভাষা কোনো জ্ঞান-ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক ধারণার সংজ্ঞার্থ বা নাম। কিন্তু শব্দ (vocabulary) হচ্ছে ভাষায় ব্যবহৃত যে কোনো অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। বস্তুত পারিভাষিক শব্দগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফলে সব শব্দই পারিভাষিক শব্দ নয়, কিন্তু সব পারিভাষিক শব্দই সাধারণ শব্দ।
পরিভাষা ও বিদেশি শব্দের পার্থক্য
সাধারণভাবে পরিভাষা এবং বিদেশি শব্দকে এক করে দেখা হয়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই দুটি বিষয়ই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
পারিভাষিক শব্দ হলো বিদেশি বা দেশীয় কোনো ভাষার মূলশব্দ বা তার অনুবাদ বা মূল শব্দের কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপ সংবলিত শব্দাবলি— যা মাতৃভাষার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। অপরপক্ষে বিদেশি শব্দ হল কোনো বিদেশি ভাষার মূল শব্দ। যেসব বিদেশি শব্দ (যেমন : আনারস, চেয়ার, রিক্শা ইত্যাদি) বাংলা ভাষায় নিত্য ব্যবহারে স্থায়ী স্থান লাভ করেছে, সেসব শব্দকে আর বিদেশি শব্দ ভেবে পরিভাষা করার প্রয়োজন নেই। কারণ এগুলো এখন বাংলা ভাষারই সম্পদ হয়ে উঠেছে। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কতকগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে ওই সকল শব্দের পরিভাষার প্রয়োজন হয়। (যেমন : পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা ইত্যাদি।) সুতরাং বিদেশি শব্দ এবং পরিভাষা মোটেই এক নয়।
পারিভাষিক শব্দের আলোচনা এবং ব্যখ্যা ও প্রয়োজনীয়তা
বাংলা পারিভাষিক শব্দ প্রণয়নের প্রচেষ্টা
বাংলা ভাষা বাঙালিদের মাতৃভাষা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত ভারত স্বাধীন হওয়ায় বৃহত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রগতভাবে দুটি ভিন্নদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। অতঃপর ‘বাংলাদেশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত ‘পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সে সময় থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় ভূষিত করার প্রয়াসে সংগ্রামী তৎপরতা শুরু হয় এবং বাংলা ভাষার উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে ‘বাংলা একাডেমী ও তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার, বাংলা ভাষার উন্নয়ন, এমনকী প্রয়োজনীয় পারিভাষিক শব্দ সৃষ্টির প্রয়াস গৃহীত হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় ভূষিত হলে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সর্বস্তরে চালু করার সরকারি নির্দেশ প্রদত্ত হয়। অফিস-আদালত শিক্ষাঙ্গনসহ নানা ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা রাষ্ট্রীয় যোগাযোগের মাধ্যম থাকায় স্বাধীন দেশের জাতীয় উন্নতির ক্ষেত্রে তা পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। তাই সরকার কর্তৃক ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল পরিভাষা—সমস্যা।
কারণ, প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজে, শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে যে ইংরেজি শব্দগুলো প্রচলিত, সেগুলোর যথোপযুক্ত বাংলা পরিভাষার অভাব পরিলক্ষিত হয়। সে কারণে পরিভাষা প্রণয়নের আশু প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ফলে বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘পরিভাষা’ প্রণয়নের প্রয়াস চলে। অবিভক্ত বাংলায় উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইংরেজি পারিভাষিক শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ প্রণয়নের চেষ্টা শুরু হয়।
পারিভাষিক শব্দের আলোচনা এবং ব্যখ্যা ও প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পরিভাষা প্রণয়ন, প্রমিতকরণ ও পরিভাষাকোষ সংকলনের কাজে বাংলাদেশ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যেই ‘বৈজ্ঞানিক পরিভাষা’, ‘প্রশাসনিক পরিভাষা’সহ বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার যেমন: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান; মৃৎবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি এবং গণিত, ভূবিদ্যা, অর্থনীতি, আইন, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, পল্লীউন্নয়ন, বাণিজ্য, সংগীত, নৃত্যকলা, সাহিত্য-সমালোচনা, ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পরিভাষা প্রণীত হয়েছে,
যা বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলা একাডেমী থেকে এ পর্যন্ত ২৯টি পরিভাষাকোষ বের হয়েছে। এগুলো বিষয় বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগছে। পরিভাষা প্রমিতকরণের একটি কাজ একাডেমীর পক্ষে করা সম্ভব কিনা এখন ভাবার সময় এসেছে। বাংলা পরিভাষা নির্মাণের সঙ্গে বাংলা প্রতিশব্দ নির্মাণকে এক করে দেখা হয়েছে।
বিগত দু’শ বছরের জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনার সঙ্গে বাংলা পরিভাষার সৃষ্টি-ইতিহাস সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। এইসব পরিভাষা মূলত প্রাতিশাব্দিক পরিভাষা, মৌল পরিভাষা নয়। জ্ঞানচর্চায় মৌলিকতা না এলে পরিভাষা নির্মাণেও মৌলিকতা আসার কথা নয়। বাংলাদেশের জ্ঞানসাধনার মৌলিক ধারা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ভাষায়ও মৌলিক পরিভাষা সৃষ্টি হবে। তখন পরিভাষার কঠিনতার তত্ত্বটি আপনা আপনিই বদলে যাবে।
পরিভাষা করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় বা পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ-বৈশিষ্ট্য বা পারিভাষিক শব্দ প্রণয়নের নীতিমালা
জ্ঞান-বিজ্ঞান বা বাস্তব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের প্রয়োজনে পরিভাষা অপরিহার্য। ভাষা আপন গতিতে চলে। কোনো শব্দ সেখানে জোর করে চাপিয়ে দেয়া চলে না। সুনির্দিষ্ট অর্থবহ ও শ্রুতিমধুর হলেই পরিভাষা সর্বজনগ্রাহ্য ও ব্যবহার্য হয়ে ওঠে। ফলে পরিভাষা তৈরির জন্যে শুধু প্রতিশব্দ বের করলেই চলবে না। এক্ষেত্রে দেখতে হয় প্রয়োগের সুবিধা, ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সংরক্ষণ, সংক্ষিপ্ততা ও উচ্চারণের সহজসাধ্য রূপ। আমাদের নিজস্ব ভাষার ভিত্তিতে অর্থাৎ ভাষায় প্রচলিত শব্দ বা শব্দাংশ জুড়ে কিংবা প্রচলিত শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটিয়ে এবং বিদেশি ভাষার সহায়তায় তথা কখনো বিদেশি পরিভাষা হুবহু গ্রহণ করে কিংবা নতুন শব্দ দিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের পরিভাষা। নিচে পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগের কতকগুলো নিয়ম উল্লেখ করা হল :
১. যেসব বিদেশি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ আছে, জটিল ও দীর্ঘ না হলে সেগুলো পরিভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ২. ইংরেজি বা আন্তর্জাতিক নামে সুপরিচিত বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের নামের অনুবাদের চেষ্টা না করে উচ্চারণানুগ বানানে সেগুলোর নাম গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন: মিটার, ক্যালরিমিটার, ট্রান্সফরমার ইত্যাদি।
৩. যেসব ইংরেজি শব্দ বা নাম আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকমণ্ডলী, গবেষক ও সাধারণ পাঠক, শ্রোতা, বক্তার কাছে খুবই পরিচিত সেগুলোর অনুবাদ না করে সরাসরি গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন : লিটার, মিটার, ফ্রিজ, প্লাগ, সিরিঞ্জ ইত্যাদি।
পারিভাষিক শব্দের আলোচনা এবং ব্যখ্যা ও প্রয়োজনীয়তা
৪. অনুবাদের সময় জটিল, কঠিন ও দুর্বোধ্য সংস্কৃতানুসারী শব্দ পরিহার করে সহজ-সরল বাংলা শব্দের ব্যবহার করতে হবে। যেমন : হিমাঙ্ক (freezing point), আর্দ্র (moist), করোটি (skull) ইত্যাদি। এ ধরনের পরিভাষা বাংলাভাষায় গৃহীত ও সুপ্রচলিত কিন্তু ‘থার্মোমিটারে’র পরিভাষা হিসেবে ‘ঘর্মমান-যন্ত্র’ প্রচলিত হয় নি। ক্ষেত্রবিশেষে লৌকিক অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত বা ব্যবহৃত ভাষা পরিভাষা রূপে আহরণ করা যেতে পারে। পারিভাষিক শব্দ যদি মূল শব্দের অর্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় তবে তার প্রয়োগ সার্থক হয়। যেমন ইংরেজি primary শব্দটি এসেছে লাতিন ‘প্রিমুস’ (primus) শব্দ থেকে। ‘প্রিমুস’ শব্দের অর্থ ‘প্রথম’। সেদিক থেকে ইংরেজি primary শব্দটির বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে ‘প্রাথমিক’।
৭. আরবি, ফারসি বা যে কোনো ভাষা থেকে প্রয়োজনীয় ও গ্রহণযোগ্য পরিভাষা গ্রহণ করা যেতে পারে।
৮. মাতৃভাষায় কোনো প্রাদেশিক শব্দ নতুনভাবে তৈরি হলে, কিংবা শব্দটি বিশেষভাবে পরিচিত না হলে অথবা শব্দটি কোন শব্দের পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সে বিষয়ে বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকলে পারিভাষিক শব্দটির পাশে বন্ধনীর মধ্যে বিদেশি শব্দটি জুড়ে দিতে হবে। যেমন : পরম দূরত্ব (absolute space) বা পরম কাল (absolute time) বলতে যা বোঝায় তার অর্থ স্পষ্ট নয়।
৯. পরিভাষা প্রণয়ন বা গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজস্ব ভাষার মৌলিকত্ব ও স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ১০. পরিভাষা অবশ্যই বাক্যে ব্যবহৃত অপরাপর শব্দের সঙ্গে যেন খাপ খেয়ে চলতে পারে, সে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি ও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
১১. বাংলায় পরিভাষা তৈরি হয় নি এমন ক্ষেত্রে বিদেশি পরিভাষাটি বাংলা কিংবা ইংরেজি অক্ষরে লেখাই উত্তম। যেমন : ক. শ্বসনের ফলে প্রচুর পরিমাণ adenosine tri phosphate (ATP) উৎপন্ন হয়।
খ. বৃক্কের যে অংশ থেকে ইউরেটার উৎপত্তি হয় সে অঞ্চলকে পেলভিস বলে।
পারিভাষিক শব্দের আলোচনা এবং ব্যখ্যা ও প্রয়োজনীয়তা
পারিভাষিক শব্দের আবশ্যকতা
পৃথিবীর কোনো ভাষাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই দেখা যায়— প্রয়োজনীয় সব শব্দ সব সময় সব ভাষাতে পাওয়া যায় না। একারণে দেশি বা বিদেশি ভাষা থেকে প্রয়োজনীয় শব্দ সরাসরি বা অনুবাদের মাধ্যমে বা কিছু পরিবর্তিত রূপে গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে। তবে ইচ্ছেমতো যে কোনো শব্দ গ্রহণ করা যায় না। অনেক সময় আক্ষরিক অনুবাদ শ্রুতিমধুর কিংবা যথাযথ অর্থবহ না হওয়ায় মাতৃভাষার প্রয়োজন ও অর্থগত সামঞ্জস্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে পারিভাষিক শব্দ গ্রহণ বা রূপান্তর করা হয়ে থাকে।
সাধারণত কথাবার্তায় পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ তেমন না হলেও বিশেষ ধরনের কাজ বা পেশার সঙ্গে পারিভাষিক শব্দের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা তাঁদের কর্মপরিসরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। যেমন : মাউস, কিবোর্ড, মনিটর, হার্ডডিস্ক, প্রসেসর ইত্যাদি। আবার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও তাঁদের কাজকর্মে চালান, ইনভয়েস, বিল ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দের ব্যবহার করে থাকেন। এভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন— “মানুষের জ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও প্রসার ঘটে। মানুষের ক্রমপ্রসারিত জ্ঞানের বিষয়কে ধারণ করার জন্য নানা নতুন শব্দের আবশ্যকতা’ দেখা দেয়। প্রাচীনকালে সংস্কৃত, গ্রিক ও চীনা ভাষায় নতুন শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল। আধুনিককালে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হওয়ায় নতুন শব্দসৃষ্টির প্রয়োজন তীব্রতর হয়েছে। ভারতীয় সভ্যতা, ইরানি সভ্যতা এবং আরবি-সভ্যতার প্রসারের কালে এইসব সভ্যতার বাহক ভাষার শব্দাবলি অন্যান্য ভাষাকে প্রভাবিত করেছে। এখনো পৃথিবীর উন্নততর ভাষাগুলো অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ভাষার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে।”
নিচে পারিভাষিক শক্তের প্রয়োজনের কয়েকটি দিক তুলে ধরা হল :
১. জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর যথাযথ অনুবাদ করতে হলে অবশ্যই পরিভাষা ব্যবহার করতে হবে। কেননা উল্লিখিত বিষয়ের সামগ্রিক ব্যাপ্তি বোঝানোর জন্যে প্রয়োজনীয় শব্দসমূহ কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষায় নাও থাকতে পারে।
২. পরিভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাপর ভাষার শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। এ ছাড়া একটি ভাষার শব্দ। অন্য একটি ভাষায় কীভাবে ব্যবহৃত হয় সে সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করা যায়।
৩. পরিভাষার মাধ্যমে ভাষার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়।
৪. পরিভাষা যেহেতু ভাষার শব্দসংখ্যা বৃদ্ধি করে সেহেতু এর মাধ্যমে ভাষার প্রকাশক্ষমতার উৎকর্ষ সাধিত হয়।
৫. অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যথাযথ শব্দের দুষ্প্রাপ্যতা। সুতরাং এই সমস্যা সমাধানে পরিভাষাই হচ্ছে একমাত্র সহায়ক উপাদান।
৬. পরিভাষার ব্যবহার ভাষার গতিশীলতা বৃদ্ধি করে। ফলে ভাষার সৌন্দর্য অনেকগুণ বেড়ে যায়।
you can follow this