হাইড্রা / Hydra: বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবীতে নানা ধরনের প্রাণীর বাস। বৈচিত্র্য রয়েছে এদের বসতি, গঠন, চলন, খাদ্যগ্রহণ, আচার-ব্যবহার, প্রজনন ইত্যাদিতে । এসব প্রাণীর মধ্যে কোনটা সরল প্রকৃতির কেউ জটিল গঠনের অধিকারী । এ অধ্যায়ে আমরা হাইড্রা, ঘাসফড়িং এবং রুই মাছ সম্বন্ধে আলোচনা করব ।
প্রাণিজগত সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হলে প্রাণীর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানা প্রয়োজন । প্রাণিজগতের সকল সদস্যকে আলাদাভাবে অধ্যয়ন করা সম্ভব নয় । এজন্য বেশি সদৃশ প্রাণী নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন পর্ব। এসব পর্বের একটি প্রাণী সম্পর্কে অধ্যয়ন করে সার্বিকভাবে সকল প্রাণীর পরিচিতি লাভ করা যায় ।
আরো পড়ুনঃ
Hydra হচ্ছে নিডারিয়া (Cnidaria) পর্বভুক্ত সরল গড়নের জলজ প্রাণী । প্রাণিজগতের দুটি পর্ব দ্বিস্তরী বা ডিপ্লোব্লাস্টিক প্রাণী (diploblastic animal) নামে পরিচিত। একটি হচ্ছে নিডারিয়া, অন্যটি টিনোফোরা (Ctenophora) । সুইজারল্যান্ডের প্রকৃতিবিজ্ঞানী আব্রাহাম ট্রেম্বলে (Abraham Trembley, 1710-1784) ১৭৪৪ সালে হাইড্রার প্রচন্ড পুনরুৎপত্তি ক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যমে এর প্রাণিপ্রকৃতিকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যার ফলে হাইড্রার ব্যাপক পরিচিতি ঘটে ।
এজন্য ট্রেম্বলেকেই হাইড্রার আবিষ্কারক হিসেবে গণ্য করা হয় । ১৭৫৮ সালে ক্যারোলাস লিনিয়াস (Carolus Linnaeus, 1707-1778) এর নাম দেন Hydra । গ্রিক রূপকথার নয় মাথাওয়ালা ড্রাগনের নামানুসারে Hydra-র নামকরণ করা হয় । ঐ ড্রাগনটির একটি মাথা কাটলে তার বদলে দুই বা তার বেশি মাথা গজাতো । Hydra ঐ ড্রাগনের মতো হারানো বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনরায় সৃষ্টি করতে পারে, তাই অনেক সময় বহু মাথাওয়ালা সদস্য আবির্ভূত হয় । মহাবীর হারকিউলিস (Hercules) অবশেষে এ দানবকে বধ করেন ।
বাংলাদেশে Hydra-র বিভিন্ন প্রজাতি
বর্তমানে পৃথিবীতে Hydra-র প্রজাতি সংখ্যা ৪০টির মতো । গায়ের রং, কর্ষিকার সংখ্যা ও দৈর্ঘ্য এবং জননাঙ্গের অবস্থান ও আকৃতির ভিত্তিতে হাইড্রার শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। ২০০৮ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের চতুর্দশ খণ্ডের (Bangladesh Encyclopedia of Flora and Fauna, vol. 14) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির হাইড্রার উল্লেখ পাওয়া যায়: ১. বাদামী বর্ণের Hydra oligactis (=H. fusca), ২. সবুজ বর্ণের Hydra viridissima (=H. viridis, Chlorohyda viris iggma) এবং ৩. বর্ণহীন বা হলুদ-বাদামী Hydra vulgaris সধিবেন বিভিন্ন প্রজাতির Hydra-র মধ্যে বাংলাদেশে Hydra vulgaris সুলভ বলে এখানে এ প্রজাতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
বাসস্থান ও স্বভাব
বাসস্থান ও স্বভাব : Hydra একটি একক মুক্তজীবী প্রাণী । মিঠাপানিতে (খাল, বিল, পুকুর,হ্রদ, ঝর্ণা) নিমজ্জিত কঠিন বস্তু এবং জলজ উদ্ভিদের পাতার নিম্নপৃষ্ঠে সংলগ্ন থেকে নিম্নমুখী হয়ে ঝুলে থাকে । স্থির, শীতল ও পরিষ্কার পানিতে এদের বেশি পাওয়া যায় । ঘোলা, উষ্ণ ও চলমান পানিতে এদের খুব কম পাওয়া যায়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেহ ও কর্ষিকাকে সর্বোচ্চ প্রসারিত করে পানিতে দুলতে থাকে । কোন কিছুর সংস্পর্শে দেহকে সঙ্কুচিত করে ফেলে । এরা মাংসাশী (অর্থাৎ অন্য কোনো প্রাণী খেয়ে জীবন ধারণ করে) । কর্ষিকার সাহায্যে খাদ্য গ্রহণ করে । চলাফেরা করে দেহের সঙ্কোচন-প্রসারণ ও কর্ষিকার সাহায্যে। দেহপ্রাচীরের মাধ্যমে ব্যাপন (diffusion) প্রক্রিয়ায় শ্বসন ও রেচন সম্পন্ন করে। মুকুলোদগম ও দ্বিবিভাজনের মাধ্যমে অযৌন জনন এবং জননকোষ সৃষ্টির মাধ্যমে যৌন জনন সম্পন্ন করে । Hydra-র পুনরুৎপত্তি (regeneration) ক্ষমতা প্রচন্ড ।
শ্রেণিতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic Position)
Kingdom : Animalia (প্রাণী)
Phylum : Cnidaria (নিডোসাইট ও সিলেন্টেরন উপস্থিত)
Class: Hydrozoa (অবিভক্ত সিলেন্টেরন)
Order : Hydroida (পলিপ দশা প্রধান)
Family: Hydridae (এককভাবে বসবাস করে)
Genus: Hydra (পুনরুৎপত্তি ক্ষমতাসম্পন্ন)
Species: Hydra vulgaris
Hydra-র বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য
আকার-আকৃতি : Hydra-র দেহ নরম ও অনেকটা নলাকার । দেহের একপ্রান্ত খোলা (ওরাল বা মৌখিক প্রান্ত) এবং অপরপ্রান্ত বন্ধ (অ্যাবওরাল বা বিমৌখিক প্রান্ত) । খোলা প্রান্তে মুখছিদ্র অবস্থিত, আর বন্ধ প্রান্তটি কোনো বস্তুর সাথে যুক্ত থাকে। দেহ অরীয় প্রতিসম (radial symmetry) এবং ১০ থেকে ৩০ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা ও প্রায় ১ মিলিমিটার চওড়া ।
বর্ণ : প্রজাতিভেদে Hydra-র বর্ণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। Hydra vulgaris প্রায় বর্ণহীন (হালকা হলুদ-বাদামী),তবে গৃহীত খাদ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী বর্ণ বৈষম্য দেখা যায় । তবে গৃহাত খাদ্যের প্রকৃতি অনুযায়া বণ বেষম্য দেখা যায়।
বহির্গঠন : একটি পরিণত Hydra-র দেহকে প্রধানত তিনটি অংশে ভাগ করা যায় : ১. হাইপোস্টোম, ২. দেহকান্ড ও ৩. পদতল বা পাদ-চাকতি । নিচে এসব অংশের বর্ণনা দেয়া হলো ।
১. হাইপোস্টোম (Hypostome) : এটি দেহের মুক্ত প্রান্তে অবস্থিত, মোচাকৃতি, ছোট ও সঙ্কোচন-প্রসারণশীল অংশ । এর চূড়ায় বৃত্তাকার মুখছিদ্র অবস্থিত ।
কাজ: মুখছিদ্রপথে খাদ্য গৃহীত ও অপাচ্য অংশ বহিষ্কৃত হয় ।
২. দেহকান্ড (Trunk) : হাইপোস্টোমের নিচ থেকে পাদ-চাকতির উপর পর্যন্ত সঙ্কোচন-প্রসারণশীল অংশটি দেহকাণ্ড । এতে নিচে বর্ণিত অংশগুলো পাওয়া যায় ।
→ কর্ষিকা (Tentacle) : হাইপোস্টোমের গোড়ার চতুর্দিক ঘিরে ৬-১০টি সরু, সঙ্কোচনশীল, দেহ অপেক্ষা লম্বা ও ফাঁপা সুতার মতো কর্ষিকা অবস্থিত । কর্ষিকার বহিঃপ্রাচীরে অসংখ্য ছোট টিউমারের মতো নেমাটোসিস্ট ব্যাটারী (nematocyst battery) থাকে। প্রত্যেক ব্যাটারীতে থাকে কয়েকটি করে বিভিন্ন ধরনের নেমাটোসিস্ট ।
কাজ: কর্ষিকা ও নেমাটোসিস্ট পারস্পরিক সহযোগিতায় আহার সংগ্রহ, চলন এবং আত্মরক্ষায় অংশ নেয়।
→ মুকুল (Bud) : গ্রীষ্মকালে যখন পর্যাপ্ত আহার পাওয়া যায় তখন মুকুল সৃষ্টিরও অনুকূল সময় ।এমন পরিবেশে দেহের প্রায় মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে এক বা একাধিক মুকুল সৃষ্টি হয় । কাজ: প্রত্যেক মুকুল একেকটি নতুন সদস্যের জন্ম দেয়। মুকুলোদগম Hydra-র অন্যতম অযৌন জনন প্রক্রিয়া ।
→ জননাঙ্গ (Gonad) : হেমন্ত ও শীতকালে দেহকাণ্ডের উপরের অর্ধাংশে এক বা একাধিক কোণাকার শুক্রাশয় (testes) এবং নিচের অর্ধাংশে এক বা একাধিক গোলাকার ডিম্বাশয় (ovaries) নামক অস্থায়ী জননাঙ্গ দেখা যায় ।
কাজ: জননাঙ্গ যৌন জননে অংশগ্রহণ করে ।
৩. পাদ-চাকতি (Pedal disc) : দেহকাণ্ডের নিম্নপ্রান্তে অবস্থিত গোল ও চাপা অংশটি পাদ-চাকতি বা পদতল ।
কাজ: পাদ-চাকতি থেকে ক্ষরিত আঠালো রসের সাহায্যে প্রাণী কোনো তলের সাথে লেগে থাকে । এ চাকতি বুদবুদ (bubble) সৃষ্টি করে প্রাণীকে ভাসিয়ে রাখতেও সাহায্য করে । চাকতির ক্ষণপদ গঠনকারী কোষের সাহায্যে গ্লাইডিং চলন সম্পন্ন হয় ।
দ্বিস্তরী বা ডিপ্লোরাস্টিক প্রাণী (Diploblastic animal)
ভ্রূণাবস্থায় যেসব প্রাণীর দেহপ্রাচীরের কোষগুলো কেবল এক্টোডার্ম ও এন্ডোডার্ম নামক দুটি নির্দিষ্ট স্তরে বিন্যস্ত থাকে, সেগুলোকে দ্বিস্তরী বা ডিপ্লোরাস্টিক প্রাণী বলে । পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে স্তরদুটি যথাক্রমে এপিডার্মিস ও গ্যাস্ট্রোডার্মিস-এ পরিণত হয়। এ দু’স্তরের মাঝখানে মেসোগ্লিয়া (mesogloea) নামক অকোষীয় ও জেলির মতো (কখনও কিছু কোষ ও তন্তুযুক্ত) একটি স্তর থাকে । Hydra দ্বিস্তরী বা ডিপ্লোরাস্টিক প্রাণীর এক আদর্শ উদাহরণ ।
এই হাইড্রা / Hydra ছাড়াও আরো দেখুন